নির্বাচনী হাওয়া ঠাকুরগাঁও-২ : একাধিক প্রার্থী আওয়ামী লীগে জোটে অনীহা বিএনপির

নির্বাচনী হাওয়া ঠাকুরগাঁও-২ : একাধিক প্রার্থী আওয়ামী লীগে জোটে অনীহা বিএনপির

গত ৩০ বছর ঠাকুরগাঁও-২ আসনে নির্বাচিত হয়ে আসছেন মো. দবিরুল ইসলাম। ছয়বারের এই এমপিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নৌকা প্রতীক পেতে এবার অনেক আগে থেকেই নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় রয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা। অন্যদিকে, বিএনপিতেও চলছে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি। জোটের স্বার্থে দুবার জামায়াতে ইসলামীকে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু এবার তাতে অনীহা দেখা দিয়েছে তাদের। জোটকে এবার দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে মনে হচ্ছে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’।

ঠাকুরগাঁও-২ আসনের আওতায় রয়েছে বালিয়াডাঙ্গী ও হরিপুর উপজেলা এবং রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড়, কাশিপুরসহ ১৬টি ইউনিয়ন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে বাদ দিলে ১৯৮৬ সাল থেকে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন মো. দবিরুল ইসলাম। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কখনও জাতীয় পার্টির সঙ্গে, কখনও বা বিএনপি অথবা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী যুদ্ধে বরাবরই জয়ী এই নেতা সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

এবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম ছাড়াও মাঠে সক্রিয় রয়েছেন- বর্তমান এমপির বড় ছেলে জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, দলের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা শাখার সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা আহ্বায়ক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রবীর কুমার রায়, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও দলের উপজেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি মো. সফিকুল ইসলাম, জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোস্তাক আলম টুলু এবং হরিপুর উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম শামীম ফেরদৌস টগর।

একসময় এ আসনের এমপি ছিলেন মির্জা রুহুল আমিন (চখামিয়া)। পিতার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে এ আসনে তাই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নির্বাচন করতে পারেন। কিছুদিন আগে এ আসনের বালিয়াডাঙ্গী ও হরিপুর উপজেলায় ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে মির্জা ফখরুল প্রধান অতিথি হয়ে এলে বিএনপির নেতাকর্মীরা তার কাছে এ দাবিও করেন। তিনি এ আসনে নির্বাচন করবেন কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ফখরুলের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, এই আসন থেকে নির্বাচন করার ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিবও আগ্রহী। আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি দুটি আসনে নির্বাচন করতে চান। বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে স্থানীয়ভাবে আরও সক্রিয় রয়েছেন- ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি এবং বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ডা. আবদুস সালাম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও সাবেক এমপি জেড মর্তুজা চৌধুরী তুলা। মির্জা ফখরুলের ছোট ভাই ঠাকুরগাঁও পৌর মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সল আমিনও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।

বর্তমান সাংসদ আলহাজ দবিরুল ইসলাম এমপি বলেন, বারবার নির্বাচিত করে এলাকার মানুষ তার ওপর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনিও এলাকায় স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ, বিদ্যুতায়নসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। মনোনয়নের ব্যাপারে হাইকমান্ডের সবুজসংকেত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে মনোনয়ন বোর্ড ও জননেত্রী শেখ হাসিনাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে নৌকার জয় ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

বর্তমান এমপি মো. দবিরুল ইসলামের বড় ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রভাষক মাজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাবা নির্বাচন না করলে এবার তিনি আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। তরুণ ও উদ্যমী সংগঠক হওয়ায় তিনি এরই মধ্যে এলাকায় ও সংগঠনের ভেতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, তার বাবা এমপি দবিরুল দীর্ঘদিন দলকে সময় দিয়েছেন। মানুষের উন্নয়নে কাজ করেছেন। উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বর্তমান এমপি নির্বাচন না করলে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন তিনি।

জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোস্তাক আলম টুলু একসময় ডাকসু সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন দলের জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। এর আগেও বিভিন্ন সময় এমপি নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী এই নেতার অবস্থান তৃণমূল পর্যায়েও শক্তিশালী। নিজের অর্থায়নে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমও চালিয়েছেন তিনি। সমকালকে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। গণমানুষের জন্য যেমন কাজ করেছেন, তেমনি দলের দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের মামলা-জামিনসহ নানা সহায়তা দিয়েছেন। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা চাইলে এ আসনে নির্বাচন করার ও নৌকার জয়ের ধারা অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রবীর কুমার রায় মনোনয়ন দিলে নির্বাচিত হওয়ার আশা প্রকাশ করে বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ছয়বারের এমপি দবিরুল ইসলাম একজন শক্ত প্রার্থী। তবে তার বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীরাও নানা সময় বিভিন্ন অভিযোগ করে আসছেন। এ অবস্থায় শুধু জনগণ নয়, দলের নেতাকর্মীরাও তার বিকল্প খুঁজছেন।

তবে এসব অভিযোগ সম্পর্কে এমপি দবিরুল ইসলাম বলেন, তার ওপর জনগণের আস্থায় ফাটল ধরাতে একটি বিরোধী পক্ষ এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।

মনোনয়নপ্রত্যাশী বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম শামীম ফেরদৌস টগর বলেন, ছাত্রলীগে রাজনীতির হাতেখড়ি নেওয়ার পর এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন। এর আগেও কয়েকবার মনোনয়ন চেয়েছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি বিজয়ী হয়ে গণমানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকতে চান।

অন্যদিকে, অতীতে জোটের স্বার্থে এ আসনে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড় দিলেও এবার তাতে নারাজ বিএনপি। দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশের মতে, বারবার হেরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পরিস্কার, জামায়াতের প্রার্থীর প্রতি ভোটারদের অনাস্থা রয়েছে। এ অবস্থায় ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে প্রার্থী করলে এ আসনকে বিএনপির নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত এমপি জেড মর্তুজা চৌধুরী তুলা বলেন, দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেও এই এলাকায় তার বাড়ি। অতীতে তিনি সংসদ সদস্যও হয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীকে বিভিন্ন সময় এ আসন ছেড়ে দিলেও তারা জয়ী হতে পারেনি। এতে পরিস্কার যে জনগণ ধানের শীষ মার্কার প্রার্থী চায়। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ মনে করে, বিএনপি থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে আসনটি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে উদ্ধার করা যাবে। মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে তিনিই জয়ী হবেন।

এদিকে, এ আসনে পরপর দু’বার অংশ নিয়েও দবিরুল ইসলামের কাছে হেরে যাওয়া জামায়াতে ইসলামীর জেলা আমির মাওলানা আবদুল হাকিম এবারও জোটের প্রার্থী হতে মরিয়া। যদিও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। ‘সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন’ হলে ভোটাররা তার পক্ষেই রায় দেবেন বলে জানান তিনি।

আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দিলে এ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও কেন্দ্রীয় মহিলা পার্টির সহসভাপতি নুরুন নাহার বেগম। মনোনয়নের জন্য ভোটের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন তিনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment